বারবারই গণচেতনা বুর্জোয়া ধনপতিদের পায়ে ভুলুন্ঠিত হয়েছে
বামপন্থী দল, সংগঠনের সমন্বয়ে "যুক্তফ্রন্ট" প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব
বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এদেশে শুধুমাত্র বামপন্থীরা, এবং গত ১০০ বছর ধরে এই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম চলছে। তাই সেই কাঙ্খিত সমাজ-রাষ্ট্র নির্মাণে কেবল বামপন্থী অর্থাৎ সমাজতন্ত্রবাদীরাই সক্ষম এবং প্রাসঙ্গিক। সত্যিকারের জন আকাঙ্খা বাস্তবায়নে সবগুলো বাম সংগঠন মিলে “যুক্তফ্রন্ট” গঠন করে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় এখনই।
জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত “চব্বিশের গণঅভ্যূত্থানে” বামপন্থীদের ভূমিকা এবং করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সভাটি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) আহ্বায়ক, আমৃত্যু বিপ্লবী কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হক-এর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে আয়োজিত হয়। আ ফ ম মাহবুবুল হক স্মৃতি সংসদ এই সভা আয়োজন করে।
সভায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের এযাবৎ ইতিহাসে ঘটা সবগুলো আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনায় বামপন্থীদের সক্রিয় ও রক্তক্ষয়ী অংশগ্রহণ রয়েছে। যদিও এসব আন্দোলন সফল হওয়ার পর তাদের আর নেতৃস্থাণীয় ভূমিকায় দেখা যায় নি ফলে কোথাও গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায়, বারবারই গণচেতনা বুর্জোয়া বা ধনপতিদের পায়ে ভুলুন্ঠিত হয়েছে। বৃটিশরা কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করেছে, পাকিস্তানিরা নিষিদ্ধ করেছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে-পরে সংগঠনটিকে ক্রমাগত দূর্বল করে দেওয়া হয়েছে। বামদলগুলোর ঐক্যের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এক পুর্ণজাগরণের সময় এখন।
প্রধান আলোচকের বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসকেরা শুধুমাত্র ধনীদের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের ক্ষমতায় আসে এবং কৃষক-শ্রমিক-মেহনতির জনতার অধিকারকে পদদলিত করে ও জন তথা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে, দাবী-প্রতিবাদ দমনে গণহত্যা চালায়।
অধ্যাপক চৌধুরী আরও বলেন, বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী প্রকৃত নির্বাচনকে ভয় পায়, সবসময় পেয়েছে। সুতরাং এখন আবার প্রকৃত নির্বাচনের সুযোগ জাতি আদায় করেছে এক স্বতস্ফূর্ত গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটার পর এখন দেশে একটি রাজনৈতিক শুণ্যতা রয়েছে যে দেশে সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত কার্যকর কোন বিপ্লবী শক্তি নেই যারা ধনিক-ক্ষমতাশালী শ্রেণীর বিপরীতে জন আকাঙ্খা ধারণ করে গণমুক্তির দিশা দিতে পারে। তাই এই শুণ্যতাকে সুযোগ হিসেবে নেওয়ার সময় হয়েছে বামপন্থীদের, সবগুলো বাম দল মিলে যদি একটি “যুক্তফ্রন্ট” গঠন করতে পারে তাহলে গণমুক্তির সত্যিকারের বক্তব্য জাতীর সামনে তুলে ধরা সম্ভব হবে, এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরী হবে।
সিপিবি’র সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, পাকিস্তান আমলে ছাত্র আন্দোলনে দুটি প্রধান ধারা ছিল, একটি ছাত্রলীগ ও অপরটি ছাত্র ইউনিয়ন। ৬৯-এর গণ অভ্যূত্থান হয়েছিল ১১ দফার ভিত্তিতে, যার নেতৃত্বে ছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, সেখানে বামপন্থী ছাত্র নেতাদের ভূমিকাই শীর্ষে ছিল। একইরকমভাবে ২৪-এর জুলাই আন্দোলনও কোন একক রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ছিল না। এখানেও বামপন্থী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। যেমন, প্রথম থেকেই ছাত্রদের সঙ্গে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি ২৬ জুলাই কারফিউ উপেক্ষা করে ৩১টি বাম সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে “দ্রোহ যাত্রা” অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি আরো বলেন, বাম সংগঠনগুলোকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। চলতি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে শুধুমাত্র পুরণোকেই পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, নতুন কিছু হবে না। অথচ এখন দরকার পূরো অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রীয়-প্রশাসনিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুও পুরনো পাকিস্তানি পদ্ধতি ৭১ চালু করেছিলেন। এখনও বর্তমান সরকার সেই আগের পদ্ধতির উপরই বহাল আছে। তাহলে জন আকাঙ্খার বাস্তবায়ন তারা কথনও করতে পারবে না।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, জুলাই অভ্যূত্থানের জনচেতনা ও জনজাগরণের চিত্রায়ণ হলো দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলো। অথচ এই জনমানুষের আকাঙ্খার এই ভাব বক্তব্যগুলো বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এই বলে যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলীয় জোটে জাসদ ও ওয়ার্কার্সপার্টিসহ বাম দল রয়েছে, অথচ এইদলগুলো কিন্তু সমাজতান্ত্রীক আদর্শধারী নয় বরং বুর্জোয়া স্বার্থ রক্ষাকারী। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে শুধুমাত্র বামপন্থাই।
সভায় আরও বক্তব্য দেন দৈনিক প্রথম আলো’র যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহবুব কামাল, শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ এর সমন্বয়ক হারুনুর রশিদ ভুইয়া এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন আহমেদ নাসু।
আ ফ ম মাহবুবুল হক স্মৃতি সংসদ-এর আহ্বায়ক বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু সাঈদ খান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা পরিচালনা করেন বাসদ নেতা মহিন উদ্দিন চৌধুরী লিটন।
সভার শুরুতে মুক্তিযুদ্ধ, দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, চব্বিশে গণঅভ্যূত্থানের শহীদ ও আ ফ ম মাহবুবুল হক এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাড়িয়ে এক মিনিটি নিরবতা পালক করা হয়।