ইতিহাস বারবারই ফিরে আসে

শোষণ-শাসন উৎখাত করেই সত্যিকারের গণতন্ত্র অর্জন হতে পারে

ইতিহাস বারবারই ফিরে আসে সে কথাই সত্য প্রমানিত। ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়, ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে। ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক। আমাদের আছে ইতিহাস গর্বের। ইতিহাস বিকৃতিকারীরা ক্ষমা অযোগ্য। যদি সম্ভব হয় সত্যকে সত্য বল, দেশ গ্রাম আজীবন মনে রাখবে। পাখিরা কখনো সীমানা বোঝে না আকাশের মেঘের মত।
আমরা কেন তাদের মত হবো, এখনই সময়-সচেতন হওয়া।

বিজ্ঞানের আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি মানুষের পরিবর্তন। দেশ, গ্রাম, সমাজ আজ আলোকায়ন সবই হাতের নাগালে, কিন্তু সুখ! ভালোবাসা ও আন্তরিকতা যান্ত্রিকতায় কালো গ্রাসে স্তদ্ধ মানব সভ্যতা। হিংসা প্রতিহিংসা রন্দ্রে রন্দ্রে, ধর্মের নামে অধর্মের কাঁদা ছোড়াছুড়ি। দেশ গ্রাম ইতিহাস বিকৃতির হিড়িক মানসিকতায় হীন প্রবণতা। আজ সমাজ উদ্বিগ্ন, খুবই প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা প্রজন্মকে কি দিয়ে যাচ্ছি। ভুলে ভরা অসংখ্য ইতিহাস, তথ্য। আগামীতে বিবাদে জড়ানো সূত্র। ইতিহাস একটি দেশের কর্ণধার। ইতিহাস ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক দলিল। ইতিহাসের পাতা বদল করা যায় না।

বর্তমান পরিস্থিতি সেই ৮০ দশকের মতই বিদ্রূপাত্মকভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই মিল পেলাম অধুনা আমাদের হাতে আসা হঠাৎ ১৯৮৪ সালে সর্বহারা পার্টির লেখা পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে লেখা একটি চিঠিতে। পরিস্থিতি একইরকম কিনা না তা পাঠক যাচাই করুক, আমরা হুবহু ছেপে দেয়ার চেষ্টা করলাম।

প্রতি-
কেন্দ্রীয় কমিটি/কেন্দ্রীয় সংস্থা
পূর্ববাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি (এম. এল.)
প্রির বন্ধুগণ,
আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য রেখেছেন যে, বিগত প্রায় দুবছর ধরে সামরিক শাসন বিরোধী যে আন্দোলন চলছে তা সম্প্রতি বেশ তীব্র হয়ে উঠেছে এবং সর্বস্তরের জনগণ সামরিক স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে তাদের অনাস্থা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ব্যাপক জনগণ সত্যিকারের গণতন্ত্রের আকাংখায় আন্দোলন করছেন এবং আন্দোলনে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু এদেশে অতীত আন্দোলনগুলোর মত এবারও প্রথম থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিগুলো এ আন্দোলনের কাতারে ঢুকে তাদের গণবিরোধী চক্রান্ত চালাচেছ।

তারা তাদের সংগঠন শক্তির জোরে এবং বিপরীতে বিপ্লবী শক্তিগুলোর দুর্বলতার সুযোগে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল কর্ম- সূচী আন্দোলনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং তাদের পথেই আন্দোলন গড়ে তুলছে ও জনগণকে বিপথগামী করছে। বি. এন. পি. ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যথাক্রমে ৭ ও ১৫ দলীয় জোট দুটো ছাড়াও সম্প্রতি জামাতে ইসলামীর মত চরম প্রতিক্রিয়াশীল দলটি ও নিজেকে “গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি’ হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য এই আন্দোলনে নেমেছে।

এরা সবাই অত্যন্ত সচেতন ভাবে প্রথম থেকেই নির্বাচনের দাবীর কানাগলিপথে আন্দোলনকে ঠেলে দিতে সচেষ্ট এবং তাদের সুবিধা গুলোর কারণে ব্যপক জনগণকে তারা বিভ্রান্ত ও করতে পারছে। প্রথম থেকেই এরা বিভিন্নরূপে তাদের দাবীকে হাজির করলেও তাতে মূল দাবী ছিল তাদের নির্বাচনের দাবীই। প্রথমে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ১৫ দলের ‘৭২ সালের সংবিধান প্রতিষ্ঠার আওয়াজ, পরবর্তীতে ১৫ দল, ৭ দল ও জামাতের সর্বাগ্রে সার্বভৌম সংসদ নির্বাচনের দাবী এবং বর্তমানে তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীর মূল কথা একটাই-তা হচ্ছে, জনগণের আন্দোলনকে নির্বাচনের দাবীর পথে পরিচালিত করা, “নির্বাচনই গণতন্ত্র’-এই প্রতিক্রিয়াশীল মোহে জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখা এবং সকল সাম্রাজ্যবাদসহ সকল বিদেশী শোষক, তাদের তাবেদার আমলা মুৎসুদ্দি পুজিবাদ ও সামন্তবাদকে টিকিয়ে রাখা। এর উদ্দেশ হচেছ জনগণ যাতে তাদের এই শত্রুদেরকে বলপূর্বক উৎখাতের পথে এগুতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা।

বামপন্থী নামধারী বেশকিছু দল ১৫ দল ও ৭ দলে ভিড়ে কার্যতঃ এই প্রতিক্রিয়াশীলদের লেজুড়ে পরিণত হয়েছে এবং তাদের স্বার্থের সেবা করছে। এজন্য তাদের কেউ কেউ “কৌশলগত ঐক্য’ বা’ ‘ইস্যুভিত্তিক ঐক্যে’র কথা বললেও কার্যত তারা বিপ্লবী রণকৌশল থেকে পরিপূর্ণ ভাবেই বিচ্যুত হয়েছে। তাদের সুবিধাবাদী আদর্শগত ও রাজনেতিক লাইন থেকেই তারা এই পথে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু বর্তমান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সাধারণ (common) দাবীর ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যকার বিপরীতমুখী দলগুলোরও সমঝোতায় পৌছতে পারা। এ কারণেই তাদের অবস্থানে গুরুতর মতপার্থক্য সত্বেও আওয়ামী লীগ ও সকল রুশ পন্থীরা এবং বি. এন. পি, ও জামাত আন্দোলনের সাধারণ কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারছে। এটা, তাদের অবস্থানে নিঃসন্দেহেই বিচক্ষণ নমনীয়তার প্রমাণ। এবং এটা একটা গুরুরপূর্ণ কারণ যে, তারা কেন আন্দোলনকে এতটা এগিয়ে নিতে পেরেছে এবং ব্যাপক জনগণসহ বিভিন্ন সুবিধাবাদী শক্তি ও মধ্যবর্তী শক্তিগুলোরে পক্ষে টানতে পারছে।

অথচ বিপরীতে সত্যিকারের বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিং শক্তিগুলোর মাঝে সমঝোতা ও ঐকোর গুরুতর অভাব রয়েছে। এটা সত্য সে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাম্প্রতিক মতাদর্শগত মহাবিতর্কে’র কারণে এদেশে এ ধরণের বিভিন্ন দলের মাঝে তীব্র বিতর্ক চলেছে ও চলছে এবং সংগ্রামকে একটুও বাদ দেয়া যায় না বা ছোট করে দেখা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশীয় পরিস্থিতিতে এজাতীয় দলের মাঝে কতকগুলো ঐক্যমত ও রয়েছে। এই আন্দোলনে পৃথক পৃথক ভাবে আমরা নিজেরা প্রত্যেকেই কম-বেশী ভূমিকা রাখছি । এবং আমাদের বক্তব্য দ্বারা জনগণকে সচেতন ও পরিচালিত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আমাদের জানামতে আপনাদের সাথে আমাদের এ প্রশ্নে মিল রয়েছে যে, আমরা উভয়েই নির্বাচন দাবীর কানা- গলিপথ সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি এবং সাম্রাজ্যবাদসহ সকল বিদেশী শোষক এবং তাদের দালাল-মুৎসুদ্দী পুজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ-শাসন উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত যে সত্যিকারের গণতন্ত্র অর্জন হতে পারে না, আন্দোলনকে যে এই শত্রুদের উৎখাতের লক্ষ্যেই পরিচালিত করা উচিত-এগুলাকে সামনে তুলে ধরছি। আমাদের জানামতে আরো কিছু সংগঠনও এভাবে কাজ করছে।

কিন্তু আমাদের মাঝে এই ঐক্যের দিকগুলো থাকা সত্ত্বেও আমাদের কাজে কোন সমন্বয় বা সবাঝোতা না থাকাতে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী শর্তগুলি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে জনগণের সামনে আসতে পারছে না। প্রতিক্রিয়াশীলরা এজন্য বিভ্রান্ত করতে আরো বেশী সুযোগ পাচ্ছে। সেজন্য আমরা মনে করি যে, আপনাদের ও আমাদের মাঝে এবং এ জাতীয় অন্যান্য সংগঠনগুলোর মাঝে আজকের আন্দোলনের প্রশ্নে ঐক্যের দিকগুলির ভিত্তিতে নিম্নতম সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত এবং আমরা কীভাবে যৌগ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারি তা নির্ধারণের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আমাদের মাঝে যোগাযোগ ও আলোচনা হওয়া উচিত।

অস্ততঃপক্ষে আজকের পরিস্থিতিতে যৌথভাবে একটা বড় ধরনের প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেও তা জনগণের মাঝে গুরত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং আমাদের যৌথ শক্তি আন্দোলনকে সঠিক পথে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে সহায়ক হতে পারে বলে আমরা মনে করি।

আজকের আন্দোলনের প্রশ্নে প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিগুলোর বিপরীতে যে দুটো মূল বিষয়কে আজ তুলে ধরা খুবই প্রয়োজন তা হচেচ্ছ-
(১) আন্দোলন করতে হবে নির্বাচনের জন্যে নয় বরং দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও দুর্নীতি উৎখাতের লক্ষ্যে।

(২) গণতন্ত্র অর্জন কোন নির্বাচনের প্রশ্ন নয়, বরং তা হচ্ছে বিপ্লবের প্রশ্ন। সকল সাম্রাজ্যবাদসহ সকল বিদেশী শোষক এবং তাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দী পুজিবাদ ও সামন্তবাদকে উৎখাত না করলে সত্যিকারের গণতন্ত্র অজিত হতে পারে না।
আমাদের বিভিন্ন দলের মাঝে অনেক বিষয়ে অনেক মতপার্থক্য সবেও ২২দল ও জামাত তথা প্রতিক্রিয়াশীল সকল পার্টি’র প্রয়ে আমাদের মাঝে এই দুটো প্রশ্নে ঐক্য রয়েছে। সুতরাং ঐক্যের ভিত্তিতে আমরা কেন সমঝোতা গড়তে পারবো না?
তাই আজকে দেশীয় যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার গুরুত্বকে স্মরণ রেখে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী শক্তিগুলোর মাঝে এই সমঝোতা গড়ার জন্য আপনারা এগিয়ে আসবেন আশা করি।

আমাদের এ চিঠির বিভিন্ন প্রশ্নেও আপনাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তবুও আমরা এর ভিত্তিতে আলোচনার আহবান জানাচ্ছি। আমরা আহবান জানাচ্ছি- আসুন, আমরা এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আলোচনা করি এবং বর্তমানের বিশেষ পরিস্থিতি লক্ষ্য রেখে আমাদের উপর ন্যাস্ত দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসি ও সম্ভাব্য পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করি।

জরুরীভাবে এ চিঠির উত্তর আমরা আশা করছি।
বিপ্লবী শুভ্যেসহ-
সর্বোচ্চ বিপ্লবী পরিষদ,
পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি

সংকলনেঃ জোসেফ ডি কষ্টা