বিদেশে থেকেও আসামি: কামরানের ন্যায়বিচারের লড়াই

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক কামরান আব্দুল হাই এক মর্মান্তিক ও অভাবনীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। নিজ দেশে না থেকেও তাকে একটি হত্যাকাণ্ড মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে। তিন বছর ধরে এই মিথ্যা মামলার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন নিজের সংগ্রামের করুণ চিত্র।

ঘটনার শুরু ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার এক ধানক্ষেতে একটি লাশ উদ্ধার হয়। অথচ কামরান সেই সময় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলেন। তিনি দেশ ছেড়েছিলেন তার অসুস্থ মাকে নিয়ে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর।

লাশ উদ্ধারের ঘটনার পরদিনই সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও দেখে বিষয়টি জানতে পারেন কামরান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার ও স্থানীয় থানার ওসিকে ফোন করেন। তবে পুলিশের প্রতিক্রিয়া তাকে আশ্বস্ত করতে পারেনি। পরে এক ফোনালাপে তিনি ওসি নাজির আলমের মুখে শুনতে পান, “দেখছো আমি কী খেলা খেললাম?”—এই বক্তব্য তাকে আরও আতঙ্কিত করে তোলে।

কামরানের অভিযোগ, ঘটনার পর সিআইডির পরিচয়ে দুই ব্যক্তি তার পরিবারের কাছে জমির দলিল দাবি করেন। অথচ পুলিশ সুপার জানান, তিনি কাউকে পাঠাননি। একই রাতে তাকে মামলার প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়।

তিনি বলেন, “আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। গ্রামের সংসদ সদস্য মানিক, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনু ও আলী হোসেনদের বিরুদ্ধে আমি দুর্নীতি ও ভূমি দখলের অভিযোগ করেছিলাম। সেটাই তাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়।”

মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে তিনি আইজিপি, পিবিআই-এর ডিআইজি, ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনার এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত আবেদন করেছেন। তিনি ফোনালাপের রেকর্ড তদন্তের দাবি করলেও অভিযোগ রয়েছে—সিআইডির কিছু কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের কারণে সত্য গোপন করা হয়েছে।

দেশে ফিরতে না পারলেও ভাই আবদুল গনিকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠান কামরান। তার দাবি, ওই সংসদ সদস্য তাকে ঘুষ দিয়ে প্রভাবিত করেন, যাতে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আর চাপ না দেওয়া হয়।

এই পুরো ঘটনার মানসিক চাপ পড়ে পরিবারের ওপর। মায়ের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যায় এবং ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কামরান বলেন, “মায়ের মৃত্যুর আগে দেশে ফিরতে পারিনি, শেষবারের মতো দেখতেও পারিনি।”

এই মিথ্যা মামলার প্রভাব শুধু পারিবারিক নয়, পেশাগত জীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে জানান কামরান। তিনি মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন না।তার দাবি, “যাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়, তাদের জন্য একটি স্বচ্ছ ও দ্রুত তদন্ত প্রক্রিয়া থাকা জরুরি। কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তারও বিচার হওয়া উচিত।”

তিনি আরও বলেন, “আমি চাই, আমার মৃত্যুর আগেই সত্য প্রকাশিত হোক। যারা অন্যায়ভাবে আমাকে ফাঁসিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এই মামলাটি যেন একদিন ইতিহাসে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।”

বিদেশে থাকা অবস্থাতেও একজন নাগরিক কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে একটি হত্যা মামলার আসামি হতে পারেন, সেটিই প্রশ্ন তুলছে দেশের বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে। প্রশাসনিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রবাসীর অসহায়ত্ব—সব মিলিয়ে এই ঘটনা একটি গভীর উদ্বেগের ইঙ্গিত দেয়।

প্রশ্ন রয়ে যায়—এখনো কি ন্যায়বিচার সম্ভব?

আরও পড়ুন: