নিখোঁজ জেলের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
সাগরে ট্রলার ডুবির ঘটনায় একমাস ধরে নিখোঁজ আব্দুর রহিম নামে এক জেলে। তিন বছরের এক সন্তান ও নবাগত সন্তানসহ সংসারের দায়িত্ব এখন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জেসমিনের ওপর। সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন ঠিক তখনি ‘আমাদের হাতিয়া’ নামে একটি মানবিক সংগঠন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জেসমিনের। নগদ অর্থদিয়ে সহযোগিতার পাশাপাশি গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার সকল দায়িত্ব ও নিয়েছে সংগঠনটি।
জানা গেছে, নিখোঁজ জেলে আব্দুর রহিমের বাড়ী নোয়াখালী হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের মোল্লা গ্রামে। গত ৯ সেপ্টেম্বর বৈরি আবহাওয়ায় ট্রলার ডুবির ঘটনায় সাগরে নিখোঁজ হন সে। ঘটনার দিন তিনি সহ ১৫ মাঝি মাল্লার ট্রলারটি ডুবে গেলে সবাই নদীতে ভাসতে থাকে। পরে ২৯ ঘণ্টা পর ভাসতে ভাসতে সবাই হাতিয়ার দমারচরে এসে পৌঁছালেও নিখোঁজ থাকেন আব্দুর রহিম।
আব্দুর রহিমদের ট্রলারের মাঝি মেহেরাজ উদ্দিন জানান, ঘটনার দিন বৈরি আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল দেখে ঘাটে ফিরে আসছিলেন তারা। পথে প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে ট্রলারের তলা পেটে পানি ডুকে যায়। একসময় ট্রলারটি সম্পূর্ণ ডুবে যায়। এসময় প্লাস্টিকের কন্টেনিয়ার ও পুলুট নিয়ে নদীতে ঝাপ দেয় ১৫ মাঝি মাল্লার সবাই। ১৫ জন দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে ভাসেন সাগরে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা সাগরে ভাসমান থেকে অনেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আব্দুর রহিম আগে থেকে বাতরোগে ভুগছিলেন। ঠাণ্ডায় তার হাত পা বেকে যাচ্ছিল। এক সময় রহিম পানিতে তলিয়ে যায়। পরে অন্যরা ভাসতে ভাসতে দমারচর গিয়ে উঠেন।
মেহেরাজ আরও জানান, আব্দুর রহিম পার্শ্ববর্তী হওয়ায় তার পরিবারের অনেক কিছু তাকে দেখতে হচ্ছে। এলাকার লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মিলাদ ও দোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই বছর নদীতে আশানুরূপ মাছ পাওয়া যায়নি। সে ডুবে যাওয়া ট্রলারের ১০ভাগের মধ্যে একটি ভাগের মালিক ছিল। সব শেষ হিসাবে ৬০ হাজার টাকার মত দেনা হয় আব্দুর রহিম। সে মারা যাওয়ায় সেই টাকা অন্যান্য মালিক সবাই পরিশোধ করে দিয়েছি। এদিগে রহিমের সংসার চালানোর জন্য নিঝুমদ্বীপে বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে ৫০ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছোট একটা বাচ্চা ও আছে। প্রতিদিন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।
নিঝুমদ্বীপ বন্দরটিলা বাজারের পল্লীচিকিৎসক বেলাল উদ্দিন জানান, আব্দুর রহিমের স্ত্রী জেসমিনকে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা দেন সবসময়। জেসমিন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রতিদিন তাকে বিভিন্ন ঔষধ খেতে হচ্ছে। নিঝুমদ্বীপে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসায় ভালো কোন ব্যবস্থা নেয়। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদে মহিলার গর্ভের সন্তানের সমস্যা হতে পারে এজন্য উপজেলা সদর হাসপাতালে যাওয়া দরকার। কিন্তু অর্থের অভাবে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। ‘আমাদের হাতিয়া’ নামে একটি মানবিক সংগঠন তার চিকিৎসার সকল ব্যয় বহন করবে বলে দায়িত্ব নিয়েছে। সংগঠনের লোকজন এসে তার সাথে ও দেখা করে গেছে বলে জানান তিনি।
আব্দুর রহিমের স্ত্রী জেমমিন জানান, গত চার বছর আগে আব্দুর রহিমের সাথে তার বিবাহ হয়। তিন বছরের একটি ছেলেও আছে তাদের। বন্দরটিলা বাজারের পাশে শ্বশুরের দেওয়া জায়গায় দোচালা একটি টিনের ঘরে ভালোই সংসার চলছিল তাদের। বন থেকে গাছ কেটে এনে টিন দিয়ে গত বছর এই ঘরটি তৈরি করে আব্দুর রহিম। বছরের পুরোটা সময় অসুস্থ থাকতেন রহিম। ভালো আয় রোজগার করতে পারতেন না। এজন্য অনেকটা টানা পোড়ানের মধ্যে চলতো সংসার। কিন্তু ট্রলার ডুবির ঘটনায় সব স্বপ্ন শেষ।
তিনি আরও জানান, ট্রলার ডুবির পর কয়েকদিন আত্মীয় স্বজনরা গিয়ে নদীতে খোঁজাখুঁজি করেছে। কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। এমনিতে সে অসুস্থ বাতরোগে । অনেক সময় ধরে ভাসতে থাকলে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ইতিমধ্যে অনেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। এর মধ্যে একটি সংগঠনের কয়েকজন এসে আর্থিক সহযোগিতা করেছে। আবার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। এতে কিছুটা চিন্তামুক্ত হলেও নবাগত সন্তান ও সংসার চালানো নিয়ে চিন্তায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু সরকারি ভাবে কোন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে জানান জেসমিন।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আমাদের হাতিয়া’ সভাপতি আয়াত হোসেন জুয়েল বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ট্রলার ডুবির ঘটনায় অনেকে নিখোঁজ ও নিহত হয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। এর মধ্যে নিখোঁজ এক জেলের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা এটা শুনার পর একটু সহযোগিতা করার চিন্তা মাথায় আসে। সম্প্রতি আমি আমার সংগঠনের কয়েকজন নিঝুমদ্বীপ গিয়ে নিখোঁজ জেলের পরিবারের সাথে দেখা করি। পরিবারটি একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ী হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল না। এর পর তাদের পারিবারিক পল্লিচিকিৎসকের মাধ্যমে নিখোঁজ জেলের স্ত্রীকে উন্নত চিকিৎসা সেবার সকল ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে উপজেলা সদর হাসপাতালে আনা ও উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে সকল ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। আমার মনে হয় পরিবারটি নিয়ে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসা দরকার। একমাত্র উপার্জন কারী নিখোঁজ হওয়ায় তিনজনের এই পরিবারটি দেখা শুনার এখন আর কেউ রইলো না।
হাতিয়া উপজেলা মৎস্য অফিস জানায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর বৈরি আবহাওয়ায় সাগরে প্রায় ২৯টি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে। ছোট বড় এসব ট্রলার হাতিয়ার বিভিন্ন ঘাটের ছিল। ঘটনার পরপরই দুএকদিনের মধ্যে অনেকে জীবিত উদ্ধার হলেও নিখোঁজ ছিল ৬ জেলে। সব শেষ মেঘনা নদীতে চার জেলের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সব শেষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে নিঝুমদ্বীপের আব্দুর রহিমসহ দুইজন।
এই বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মিল্টন চাকমা জানান, ট্রলার ডুবির ঘটনায় নিহত জেলে পরিবার ও জীবিত উদ্ধার হওয়া অসুস্থ জেলেদের আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। কিন্তু নিখোঁজ জেলেদেরকে সহযোগিতা করার কোন সুযোগ সরকারি ভাবে নেয়। এরপরও নিঝুমদ্বীপের নিখোঁজ জেলের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা এটা জানার পর অনেক সংগঠনকে ব্যক্তিগত ভাবে আমি বলেছি তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য। আমি শুনেছি ইতিমধ্যে আমাদের হাতিয়া নামে একটি সংগঠন অসহায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমিও ব্যক্তিগত ভাবে এই পরিবারকে কিছু সহযোগিতা করবো বলে চিন্তা করেছি।