গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী শ্রমিক হত্যা-গণঅভ্যুত্থানের কলঙ্ক
শাহবাগে শ্রমিক আন্দোলনে লাগাতারভাবে যৌথ বাহিনীর লাঠিচার্জ ও গুলি চালানো বন্ধ এবং হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার, অবিলম্বে সকল বকেয়া পরিশোধে মালিকদের বাধ্য করা ও নানা অযুহাতে ছাঁটাই বন্ধে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ এবং অবিলম্বে বন্ধ সকল কারখানা চালুর ছাত্র—শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে একই সাথে প্রশ্ন তোলা হয়, অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এই হত্যকাণ্ডের দায় কার?
সভায় বক্তারা বলেন, “অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গার্মেন্টস, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন কারখানায় মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। বকেয়া বেতন—বোনাস না দেয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রমিক এলাকাগুলোতে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিল বৃদ্ধি, বকেয়া বেতন—বোনাস, ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় গত দুই মাস যাবৎ আন্দোলন করছে।
শ্রমিকদের প্রত্যাশা ছিল ফ্যাসিবাদী শাসনামলে কারখানাগুলো যে তীব্র শোষণ এবং অত্যাচার হতো এবার সেসবের মীমাংসা হবে। শ্রমিকের পাওয়াদি যথাসময়ে আদায় নিশ্চিত এবং কারখানায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে। ছাঁটাই, দমন—পীড়নের হাত থেকে শ্রমিকরা মুক্ত হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপ নিলো। অন্তবর্তী সরকারও সেই পুরনো পথেই শ্রমিক আন্দোলনকে দমন শুরু করলো। দফায় দফায় বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এ পর্যন্ত যৌথবাহিনীর গুলিতে দুই জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য, এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন অনেকেই’’।
সমাবেশে আরো বলা হয়, “৩০ সেপ্টম্বর আশুলিয়ায় যৌথ বাহিনীর গুলিতে ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড এর শ্রমিক কাওসার হোসেন খান নিহত হন। একই সাথে ন্যাচারাল ইনডিকো কারখানার ওবায়দুল মোল্লা ও রাসেল এবং ন্যাচারাল ডেনিমস এর নাজমুল হোসেন ও নয়ন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এখনো চিকিৎসাধীন আছে। এই শ্রমিকরা এবং তাদের পরিবার ইতোমধ্যই ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। ২৩ অক্টোবর বকেয়া বেতনের দাবিতে আশুলিয়ার জেনারেশন নেক্সট কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকরা যৌথ বাহিনীর আক্রমনে গুলিবিদ্ধ চম্পা খাতুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ তারিখ মৃত্যুবরণ করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর চন্দ্রা পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার এপেক্স হোল্ডিংস লিমিটেড (গার্মেন্টস কারখানা) শ্রমিকরা হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিলের দাবিতে সংগঠিত হলে যৌথ বাহিনী গুলি চালালে গর্ভবতী নারীসহ অনেকে অহত হয়। তিনজন শ্রমিককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়।
গত দেড় মাস যাবৎ বকেয়া বেতনের দাবিতে গাজীপুরের টিএনজেড—এর কারখানাগুলোর শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। সেনা বাহিনী কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও সেটা এখনো বাস্তবায়ন করেনি। ইতোমধ্যে এই কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ বন্ধ করা হয়েছে। ফলে শ্রমিকরা আরও বিপাকে পড়েছে পাওনা আদায় নিয়ে। গতকাল মিরপুরের ক্রিয়েটিভ ডিজাইনারস লিমিটেড—এর মালিকপক্ষ মাসের শেষে এসে বেতন না দেয়ার জন্য উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত এক নোটিশ জারি করে। এতে শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলে ডায়নাসহ বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা এতে যোগ দেয়। এখানেও যৌথবাহিনী নৃশংস হামলা ও গুলি চালায়। এভাবে প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের আন্দোলনে গুলি চালাচ্ছে রাষ্ট্রীয় যৌথবাহিনী। অন্তবর্তী সরকার প্রদত্ত সেনা বাহিনীর ম্যাজিট্রেস্টি ক্ষমতা শ্রমিকের বকেয়া আদায়ে কাজে আসেনি উল্টো শ্রমিকদের দমনেই সেটা বেশি তৎপর”।
সভায় বক্তারা শ্রমিকদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে ‘ত্রি—পক্ষীয় ১৮ দফা’ চুক্তিনামা স্বাক্ষরের এক মাস অতিক্রান্ত হলেও কারখানাগুলোতে সেটার পূর্ণ বাস্তবায়ন যে দেখা যাচ্ছে না সেই বিষয়টি উল্লেখ করেন। পাশাপাশি আরও বলেন যে, “এই চুক্তিনামা বাস্তবায়নে মালিকপক্ষকে বাধ্য করতে সরকারের কোন পদক্ষেপও নেই। চুক্তিনামা অনুযায়ী অক্টোবরের মধ্যই সকল বকেয়া পরিশোধের ওয়াদা থাকলেও সেটা প্রশ্নহীভাবে ভঙ্গ করে চলেছে মালিকপক্ষ।
একই সাথে কারখানাগুলোতে নানা অযুহাতে কিংবা আন্দোলনে যুক্ততার কারণে ছাঁটাইয়ের অতঙ্কও তৈরি হয়েছে। অনেক কারখানায় ছাঁটাই চলেছেও গোপনে। ছাঁটাই এবং কার্ম হারানোর ভয়ে অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা অত্যাচার, শোষণ—নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাবি—দাওয়াগুলো তুলতেও পারছে না ঠিকমতো। গার্মেন্টস—টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে অত্যাচার আর দমনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফ্যাসিবাদী শাসনামলের মতোই এখনো মালিকপক্ষ প্রকাশ্যই ‘১৮ দফা’ চুক্তিনামা ভঙ্গ করছে। অথচ সরকার মালিকদের শ্রমিকবিরোধী এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। উল্টো দমন—পীড়ন, হত্যার পথই বেছে নিচ্ছে সরকার।
অন্তবর্তী সরকার শ্রমিকদের দাবিগুলোতে দৃষ্টি না দিয়ে বরং আগের মতোই বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং ফ্যাসিস্ট আমলাতন্ত্রের দৃষ্টিতেই শ্রমিকদের দাবিগুলো মীমাংসার চেষ্টা করছে। যা স্পষ্টতই ছাত্র—জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। অভ্যুত্থানের অর্জন ও আকাঙ্ক্ষাকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার এখতিয়ার এই সরকারকে কেউ দেয় নি!”
ছাত্র-শ্রমিক সমাবেশ থেকে অতি দ্রুত শ্রমিক হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার, অবিলম্বে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধ, বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া এবং ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
সভায় বক্তব্য রাখেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের প্রেসিডেন্ট মোশরেফা মিশু , গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য রাশেদ শাহরিয়ার, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডঃ হারুন-উর-রশীদ, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের আহবায়ক বিপ্লব ভট্টাচার্য, গণতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলন সদস্য সচিব সুশান্ত সিনহা সুমন, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক প্রমদজ্যোতি চাকমা, গাজীপুরের গার্মেন্টস শ্রমিক ইসহাক, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের আহবায়ক বিপ্লব ভট্টাচার্য, জাতীয় রিকশা চালক সংগঠনের সংগঠক ওবায়দুল ইসলাম, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নেতা মঞ্জুর মঈন,গার্মেন্টস শ্রমিক প্রতিনিধি ইকরামুল হক, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের শ্রমিক নেতা ইকবাল কবীর এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী। এছাড়াও গনতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিচকা ত্রিপুরা, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান লাল্টু, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সদস্যরা এবং টিএনজেড গার্মেন্টসের শ্রমিকরা এই সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেন।